আজ শোকাবহ ১৫ আগস্ট, জাতীয় শোক দিবস। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের স্থপতি, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৮তম শাহাদতবার্ষিকী। ১৯৭৫ সালের এই দিনে ইতিহাসের নৃশংস ও মর্মস্পর্শী এক হত্যাকাণ্ডে বাংলাদেশের মানুষ হারায় জাতির পিতাকে।
কবির কলমের কালো অক্ষরে ফুটে ওঠে বেদনাবিধুর হাহাকার- ‘এই সিঁড়ি নেমে গেছে বঙ্গোপসাগরে,/সিঁড়ি ভেঙে রক্ত নেমে গেছে-/বত্রিশ নম্বর থেকে/সবুজ শস্যের মাঠ বেয়ে/অমল রক্তের ধারা বয়ে গেছে বঙ্গোপসাগরে।’
ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলেও পারেনি তার অস্তিত্ব মুছে ফেলতে। বরং তার উপস্থিতি এই জনপদে, এই জনমানসে দিন দিন উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়েছে। এ দেশের মানুষের হৃদয়ে তিনি ঠাঁই পেয়েছেন অমর অভয় পথিকৃৎ হিসেবে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এ দেশের প্রতিটি মানুষ আজ মঙ্গলবার গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে জাতীয় শোক দিবস পালন করবে। জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ উপলক্ষে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
জাতীয় শোক দিবস এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৮তম শাহাদতবার্ষিকী উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব মো. জয়নাল আবেদীন জানান, ‘সকাল সাড়ে ৬টায় রাজধানীর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের সামনে রক্ষিত জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন।’এর আগে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর প্রাঙ্গণে রাষ্ট্রপতিকে স্বাগত জানাবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী উভয়েই সেখানে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন।
জাতীয় শোক দিবসের পরিপ্রেক্ষিত
দীর্ঘ সংগ্রামের পথপরিক্রমায় ১৯৭১ সালে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাত্র সাড়ে তিন বছর পেরুতে না পেরুতেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর একদল বিপথগামী সদস্যের ষড়যন্ত্রে ও রক্তপাতময় ক্যু’র মাধ্যমে জীবন দিতে হয় মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। ভয়াল এই হত্যাযজ্ঞে বঙ্গবন্ধু পরিবারের শিশু থেকে শুরু করে অন্তঃসত্ত্বা নারীও সেদিন রেহাই পায়নি ঘাতকদের হাত থেকে। ওই রাতে শুধু ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনেই নয়, বঙ্গবন্ধুর ভাগনে শেখ ফজলুল হক মনি ও বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাসায়ও হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের সময় বিদেশে অবস্থান করার কারণে প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।
বঙ্গবন্ধু ছাড়াও সেই রাতে হত্যা করা হয় তাঁর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব, তিন ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শিশুপুত্র শেখ রাসেল, পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর একমাত্র ভাই শেখ আবু নাসের, বঙ্গবন্ধুর ফোন পেয়ে ছুটে আসা কর্নেল জামিলউদ্দিন আহমেদ, এসবির কর্মকর্তা সিদ্দিকুর রহমান ও সেনাসদস্য সৈয়দ মাহবুবুল হককে। ওই কালরাতেই বিপথগামী সেনাসদস্যদের আরেকটি দল বঙ্গবন্ধুর ভাগনে যুবলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মনির বাসায় হামলা চালিয়ে তাকে এবং তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনিকে হত্যা করে। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও তার কন্যা বেবি, পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত বাবু, সেরনিয়াবাতের বড় ভাইয়ের ছেলে সজীব সেরনিয়াবাত এবং এক আত্মীয় আবদুল নঈম খানকেও হত্যা করা হয়।
বঙ্গবন্ধুর এই হত্যাকান্ডের পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উল্টোপথে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ। বারবার সংশোধনী এনে ক্ষতবিক্ষত করা হয় সংবিধানকে। ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ রুদ্ধ করা হয়। এমনকি হত্যাকারীদের দেশের বাইরে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে দীর্ঘ ২১ বছর বাংলাদেশ বিচারহীনতার কলঙ্কের বোঝা বহন করতে বাধ্য হয়। দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার পর এ হত্যাকাণ্ডের বিচার শুরু হয়। নিয়মতান্ত্রিক বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ২০১০ সালে ঘাতকদের ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়। ১৫ আগস্টকে জাতীয় শোক দিবস এবং এই দিনে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়।
নানা কর্মসূচি
জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে সরকারিভাবে নানা কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেতার, বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এবং বিভিন্ন সংবাদপত্রে থাকছে জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে বিশেষ আয়োজন ও ক্রোড়পত্র।
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আজ মঙ্গলবার সূর্যোদয়ের সময় বঙ্গবন্ধু ভবন এবং কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সারা দেশে সংগঠনের সকল স্তরের কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিত ও কালো পতাকা উত্তোলন করা হবে। রাষ্ট্রীয় কর্মসূচির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সকাল সাড়ে ৬টায় ধানমন্ডি বত্রিশ নম্বরে ঐতিহাসিক বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করা হবে। সকাল সাড়ে ৭টায় বনানী কবরস্থানে ১৫ আগস্টের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন, মাজার জিয়ারত, ফাতেহা পাঠ, মোনাজাত ও মিলাদ মাহফিল হবে। বেলা ১১টায় রয়েছে টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন, ফাতেহা পাঠ, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল। এ কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা, গোপালগঞ্জ জেলা ও টুঙ্গিপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতারা অংশ নেবেন। বাদ জোহর কেন্দ্রীয়ভাবে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমসহ দেশের সকল মসজিদে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল হবে।
দেশব্যাপী বিশেষ প্রার্থনা কর্মসূচির অংশ হিসেবে কেন্দ্রীয়ভাবে বেলা ১১টায় মিরপুর-১০-এর মিরপুর ব্যাপ্টিস্ট চার্চে বিশেষ প্রার্থনা, সকাল ১০টায় রাজধানীর মেরুল বাড্ডায় আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ বিহারে বৌদ্ধ সম্প্রদায় এবং বেলা ১১টায় ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে হিন্দু সম্প্রদায় প্রার্থনা সভা করবে। দুপুরে সারা দেশে অসচ্ছল, এতিম ও দুস্থ মানুষদের জন্য খাদ্য বিতরণ ও গণভোজের আয়োজন করা হবে। বাদ আসর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে ঐতিহাসিক বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে মহিলা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল হবে। এ ছাড়া আগামীকাল বুধবার বিকাল সাড়ে ৩টায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জাতীয় শোক দিবসের স্মরণ সভা অনুষ্ঠিত হবে। স্মরণ সভায় সভাপতিত্ব করবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৮তম শাহাদতবার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস যথাযথ মর্যাদা এবং ভাবগম্ভীর পরিবেশে পালনের জন্য দলীয়, সহযোগী, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং সংস্থাসমূহের সকল স্তরের নেতাকর্মী, সমর্থক ও দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগের সকল জেলা, মহানগর, উপজেলা, পৌর, ইউনিয়ন, ওয়ার্ডসহ সব শাখার নেতাদের কেন্দ্রীয় কর্মসূচির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে দিবসটি স্মরণ ও পালন করার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে।